ভূস্বর্গের পথে – লাদাখ কাশ্মীর


স্বর্গের পথে যাত্রা। স্বপ্ন হল সত্যি। প্রায় ২ বছর ধরে অনেক বার প্লান করে আবার পিছিয়ে এসে অবশেষে এই সেপ্টেম্বরে এসে সফল হলাম।
পুরো প্লানঃ ঢাকা – কোলকাতা – দিল্লী – মানালী – জিসপা – লেহ – নুব্রা – ডিস্কিত – হুন্ডার – প্যাংগন – লেহ – কারগীল – শ্রীনগর – পেহেলগাম – জম্মু – দিল্লী – কোলকাতা – ঢাকা।
পুরো এলবামঃ
ফেসবুকঃ www.facebook.com/media/set/?set=a.10214330488837409&type=1&l=7fea88e8aa
ফ্লিকারঃ www.flickr.com/photos/162644243@N06/albums/72157703306658211
যারা লাদাখ ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য সতর্কতামূলক পোস্ট এটি।
১। মানালী থেকে লেহ হয়ে শ্রীনগর পর্যন্ত হাইওয়েতে কয়েকটা উঁচু পাস পরে, যেগুলোর উচ্চতা অনেক বেশি। লেহ শহরের উচ্চতাও অনেক বেশি। অক্সিজেন স্বল্পতা এবং তুলনামূলক কম বায়ুচাপের কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। যাবার আগে অবশ্যই নিজের স্বাস্থ্য চেক করিয়ে নিবেন। বেশি বয়স হলে এবং হার্টের সমস্যা থাকলে এই রুটে ভ্রমণ না করাই শ্রেয়।
২। পুরো রুটটি কভার করতে হলে শ্রীনগর থেকে শুরু করাই ভাল। শ্রীনগর থেকে লেহ আস্তে আস্তে উপড়ে উঠে, যার কারণে শরীর এডজাস্ট করার মত পর্যাপ্ত সময় পায়। মানালী থেকে লেহ হটাত করে অনেক উপড়ে উঠে। মানালী থেকে রোটাং-ই অল্প সময়ে ৫-৬হাজার ফুট উঁচুতে। এই রুটে তাই বেশি অসুস্থ হয় মানুষ।
৩। মানালী – লেহ এবং লেহ – শ্রীনগর এক দিনে ট্রাভেল না করাই ভাল। আমরা মানালি – লেহ রুটে জিসপাতে আর লেহ – শ্রীনগর রুটে কারগিলে নাইট স্টে করেছিলাম।
৪। লেহ তে পৌঁছে একদিন বিশ্রাম অবশ্যই নিবেন, সময় থাকলে ২ দিন। যারা দিল্লী থেকে ফ্লাই করে লেহ তে যাবেন, তাড়া ২ দিন রেস্ট নিবেন লেহতে। এতে AMS এটাক হবার চান্স কমে যায়।
৫। উঁচু পাসগুলোতে বেশি সময় কাটাবেন না। ২০ মিনিটের মধ্যেই নেমে যাওয়া উচিত।
৬। উঁচু স্থানে না ঘুমানোই শ্রেয়।
৭। যাবার আগে ওষুধ সাথে নিবেনঃ
– নাপা এক্সট্রা
– জয়ট্রিপ/অমিডন
– গ্যাসের ওষুধ
– টাফনিল
– ফ্লাজিল
– ইমোটিল
– এলাট্রল
– স্যালাইন (১০ প্যাকেট)
আর AMS এটাক থেকে রক্ষা পেতে এসিমক্স (ভারতে ডায়ামক্স) খাবেন, মানালী ঢোকার ২ দিন আগে থেকে। যখন মনে হবে আপনার শরীর এডজাস্ট হয়ে গেছে, তখন খাওয়া বন্ধ করবেন। আমরা লেহ এর ৩য় দিন পর্যন্ত খেয়েছিলাম।
এসিমক্স খেলে আপনার প্রস্রাবের হার বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটা মাথায় থাকলে চলবে না। কারণ পুরো টুঁরে আপনাকে প্রচুর পানি খেতে হবে। স্বল্প অকিজেনে এই পানিই আপনার অক্সিজেনের চাহিদা মিটাবে।
এসিমক্স এ অনেকের এলার্জি থাকে। সুতরাং, যেকোনো ওষুধ খাবার আগে অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিবেন। আমি কিন্তু ডাক্তার না। আপনার শরীর আপনার ডাক্তারই ভাল বুঝবে।
AMS এটাক হবার পড়ে এসিমক্স খেলে কোন কাজ হয় না। এটা আগে থেকেই খেতে হবে।
৮। সানস্ক্রিন মাস্ট। তা না হলে দেশে ফেরার পর, আপনার বাসার লোক কেউ আপনাকে চিনতে পারবে না।
৯। ভেসলিন রাখবেন। তিব্বত পমেডটা অনেক ভাল। নাকের ভিতরে ভাল করে মেখে দিবেন। ঘুমানোর সময় সারা মুখে মেখে রাখবেন।
১০। মাস্ক রাখবেন সাথে। না হলে ঠাণ্ডা বাতাস তীরের মত বিঁধবে নাকে।
১১। মাঝে মাঝে নাক দিয়ে শুকনো বা তরল রক্ত পড়তে পারে। যদি অনেক বেশি না হয়, তবে চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু বেশি হলে, ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
১২। সাথে অনেক পিওর চকলেট রাখবেন। যত পারেন, চকলেট খাবেন। এটা স্বল্প অকিজেনে আপনাকে ক্যালরি দিবে।
১৩। পেট খালি রাখা যাবে না। প্রচুর শুকনো খাবার সাথে রাখবেন। কাজু বাদাম বেশ কাজের। অল্প খেলেই পেট ভোরে, আবার ক্যালরিও দেয় অনেক।
১৪। জোরে হাঁটা, দৌড়ানো যাবে না। ভারী জিনিস বেশিক্ষণ বহন করবেন না। চেষ্টা করবেন যাতে শ্বাস ভারী না হয়।
১৫। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবেন, মন ভাল থাকলে অনেকটাই সুস্থ থাকা যায়।
১৬। যেকোনো ধরনের সমস্যা মনে করলে স্থানীয় দের সাহায্য নিন। লাদাখের মানুষ অনেক অনেক হেল্পফুল। লেহ হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ ও কম। ৬৫টাকা এক্সরে!
১৭। যদি সময়ে মিলে, তাহলে সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে অক্টোবরের ১০ এর মধ্যে ভ্রমণ করবেন। এই সময়ে রাস্তা থাকে সবচেয়ে ভাল এবং মসৃণ। আর সিজন শেষের দিকে বিধায় ভিড় কম থাকে অনেক।
মজার ব্যাপার হল, অনেকের কিছুই হয় না এই রুটে ভ্রমণে, আবার অনেক শক্তিমান মানুষও কাবু হয়ে যায়। আমার মতে সতর্ক থাকা ভাল, তাই বলে সারাক্ষণ ভয় পাবেন না।
এবার আসি মূল গল্পে।
রাজ্যের নাম শুধু কাশ্মীর না, জম্মু ও কাশ্মীর। কিন্তু আমরা সবাই কাশ্মীর নামেই চিনি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল জীবনে একবার হলেও কাশ্মীরে আমার পা রাখতেই হবে। যখন প্রথম বার গুজরাট যাই, তখনই চেয়েছিলাম যে কাশ্মীর ঘুরে আসব, কিন্তু হয়নি। এরপর গেলাম দার্জিলিং, তখনও কাশ্মীর যাবার প্লান ছিল। পরেরবার মোটামুটি শিওর হয়ে পাক্কা প্লান করলাম। একেবারে শেষ মূহুর্তে যেতে হল হিমাচল। তার পরের বার, আরও ভালভাবে প্লান করে শুধু শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে এলাম!
এবার যাবার আগেই উঠে পড়ে বসলাম। অনেকদিন ধরে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে, অনেকের সাথে প্লান করে ট্যুরমেট খুঁজতে বসলাম। কয়েকটা গ্রুপ হয়েও যখন ভেঙ্গে গেল, তখন ঠিক করলাম যে কজন পাই, তাই যাব – খরচ হয়তো একুটু বেড়ে যাবে। সবশেষে তিনজন হলাম। অনেক আশা করে শেষে আর একটা পোস্ট দিলাম এবং এবার হুড়হুড় করে সহযাত্রী পেয়ে গেলাম। ফাইনালি আমরা ১১জন হলাম। অনেক বড়ও গ্রুপ। শুরু করলাম স্বর্গের পথে যাত্রা!
আমাদের প্লান ছিল আসলে লাদাখ ভ্রমণ। সাথে কাশ্মীর যতটা কভার করা যায়। এই ট্যুরের বিশেষ আকর্ষন হল ২টা হাইওয়ে – মানালি – লেহ এবং লেহ – শ্রীনগর। বিশ্বের সবচেয়ে ১০টা ভয়ংকর ন্যাশনাল হাইওয়ের মধ্যে এই ২টা আছে। আর আমি বাই রোড জার্নি করতেই বেশি পছন্দ করি। তাই আগে থেকেই সবাই মিলে সব ঠিক করে ফেললাম। হোটেল বুকিং আর ট্রান্সপোর্টে সাহায্য করেছে এক খচ্চর টাইপের দালাল (তাকে নিয়ে পড়ে একদিন বলব)। আর ট্রেনের টিকেট কাটতে সাহায্য করেছে এক ছোটো ভাই। সব ফাইনাল করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করলাম।
এই র্যুটে সময় থাকা সত্ত্বেও যারা এয়ারে যাবেন, তারা ৯০% মিস করবেন। সুতরাং, একটু সময় করে হলেও বাই রোডে যাবেন।
কাশ্মীর আসলে তিন ভাগে বিভক্ত। জম্মু কাশ্মীর, শ্রীনগর কাশ্মীর এবং লাদাখ কাশ্মীর। কাশ্মীর এর রাজধানী ২টা। শীতকালীন রাজধানী হল জম্মু আর গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হল শ্রীনগর। লাদখের মানুষ আসলে নিজেদের কাশ্মীরী ভাবতে চায় না। আবার কাশ্মীরের লোকজনও লাদাখকে কাশ্মীরী ভাবতে চায় না। তবু লাদাখ হল কাশ্মীরের মধ্যে। লাদাখ কাশ্মীরের রাজধানী হল লেহ, যেটা আসলে অফিসিয়াল স্টেট রাজধানী না।
যাবার আগে দিন তারিখ নিয়ে অনেক প্লান করলাম। ঠিক করলাম সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহেই যাব। অনেকেই আমাকে না করেছে, অনেকে হেসেছেও। কিন্তু আমি নিজে কয়েকজন ব্লগার, ভ্লগার আর ড্রাইভারের সাথে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গিয়ে দেখলাম আমি একদম সঠিক ছিলাম। সিজনের শুরুতে বরফ পরিষ্কার করার সময় BRO (Border Road Organization) একবার রাস্তা মেরামত করে। কিছুদিন পরেই বৃষ্টি শুরু হয়। তখন আবার ল্যান্ডস্লাইড হয়। ফোলে আবারো রাস্তা ভাঙ্গে। তখন তাড়া আবার রাস্তা ঠিক করে। তাই সিজনের শেসে রাস্তা থাকে একদম ভালো। পাশাপাশি ট্যুরিস্ট কম থাকে বিধায় আরামে ঘোরা যায়। দামও কিছুটা কম থাকে।
যাই হোক, শুরু হল আমাদের স্বপ্নের পথে যাত্রা।
২০শে সেপ্টেম্বরঃ সকালে আমরা ৬জন ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেসে করে কোলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ২ জন বাসে করে কোলকাতা গেল। আর তিনজন এদিন রাতে রওয়ানা দিল বাসে। রাত ৮টার দিকে আমরা ৬ জন কোলকাতা নেমে আমরা ২জন রিটার্ন টিকিট কেটে ফেললাম চিতপুর থেকে। ফেরার সময় বাকিরা সবাই মোটামুটি আলাদা ভাবে আসবে, সে রকমই প্লান। রাতে আমরা ৬জন ঠাকুরপুকুর একটা হোম স্টেতে ছিলাম। আমি যখনি কোলকাতা যাই, আমি ওখানেই থাকি, শুধুমাত্র হোমের মালিকের হাতের রানার জন্য। তিনি একজন মহিলা এবং আমি দিদি ডাকি। আর ওনার রানার হাত অসাধারণ!
২১শে সেপ্টেম্বরঃ সকালে ডলার ভাঙ্গিয়ে ৪টার মধ্যে সবাই পৌঁছে গেলাম শিয়ালদাহ যেখান থেকে আমাদের দিলীর ট্রেন ৫টায় – রাজধানী এক্সপ্রেস। আমরা ১১জন এখানেই আসলে একত্র হলাম সবাই। সময়মতো উঠে পড়লাম ট্রেনে। রাজধানী এক্সপ্রেস অদ্ভুত এক ট্রেন। ওঠার পড় থেকেই শুরু শুধু খাওয়া। বিভিন্ন রকম নাস্তা একের পড় এক চলতে থাকে রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত। রাতের খাবারে পরিমাণে এত দেয়, শেষ করা কষ্ট হয়ে যায়। ভাতের সাথে ২টা রুটি, সবজি, মাছ বা মাংস বা পনির, দই। আবার শেষে একটা আইসক্রিম দিবে। সকালে উঠতে না উঠতেই চা, টোস্ট-বাটার হাজির। এর পড়ে আবার নাস্তা!! খেতে দিল্লী পৌঁছে যাবেন। রাজধানীতে আবার ফ্রী ওয়াই ফাইও আছে। ভারতের মোটামুটি সব বড় ষ্টেশনেও ফ্রী ওয়াই ফাই আছে। যদিও কানেক্ট করতে আপনার একটি সিম থাকতে হবে।
২২শে সেপ্টেম্বরঃ সকালে দিল্লী নেমেই আমরা পাহাড়্গঞ্জে ২টা রুম নিয়ে নিলাম। একটা মেয়েদের জন্য আর একটা ছেলেদের জন্য। সবার একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। আগের দিন ট্রেন থেকেই অমানবিক বৃষ্টি পাচ্ছি, তাই কারও মন ভাল নেই। সবার মাথায় টেনশন – যে এরকম বৃষ্টি থাকলে রোটাং পাস বন্ধ থাকবে। আমাদের মানালিতেই বসে থাকতে হবে। হয়তো ২-১ দিন লসই হবে – ইত্যাদি ইত্যাদি। দিল্লীতে সেই বৃষ্টির মাঝেই দুপুরে লাঞ্চ করতে বের হলাম। খাবার আগে যে কয়েকটা জায়গা দেখব তার কোন উপায় নেই। একটা দোকানে ঢুকে ভেজ থালি খেয়ে নিলাম। দাম কম ছিল, আর খাবারও ভালই ছিল। বিকেলে বের হয়ে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশন মেট্রো স্টেশন যেখান থেকে আমাদের ভলভো গাড়ি যাবে মানালির উদ্দেশ্যে। বৃষ্টিতে ভিজে সবাই জুবুথবু অবস্থা।
আমাদের বাসের ড্রাইভার ছিল একজন শিখ। ড্রাইভিং এর উপর তার অগাধ দক্ষতা। যেভাবে স্টিয়ারিং এর উপর দুই কনুই রেখে (অনেকটা টেবিলে কনুই রেখে মোবাইল টিপার মত) দুই হাতে পান মসলা বানাচ্ছিল আর পাশাপাশি গাড়ি ১১০ থেকে ১২০ এর মধ্যে রেখে, এক কথায় অসাধারণ। প্রথম দিকে যদিও ভয় লাগছিল, কিন্তু পরে বুঝলাম এ অনেক ঝানু মাল – কোন ব্যাপারই না তার জন্য। ডিনারের আগে মাঝে আরও ২বার ব্রেক দিল। সুযোগ পেলেই আমরা নেমে চা-ধুয়া খেয়ে নিলাম (যার যেটা লাগে আর কি)।
প্রথম ধোঁকা খেলাম ডিনারে। খুবই অল্প সময় দিয়েছিল ডিনারের জন্য। আমরা নেমে তড়িঘড়ি করে খেতে গিয়ে চিকেনের অর্ডার দিয়ে দেখি ধোঁকার তরকারি দিয়ে গেছে। ধোঁকা হল আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরী এক ধরনের তরকারী। ঠিকমত রান্না করতে পারলে খেতে অসাধারণ লাগে। খেতে অনেকটা চিকেনের মতই লাগে। তাই বলে চিকেন এর কথা বলে ঐ তরকারি দিবে, এটা মানা যায় না। ঝামেলা টামেলা করে কোন রকম খেয়ে গাড়িতে উঠলাম।
২৩শে সেপ্টেম্বরঃ সকাল হবার সাথে সাথেই মুগ্ধ হওয়া শুরু, কারণ আমরা তখন মানালির কাছাকাছি। মানালি এটা আমার দ্বিতীয় বার। প্রথম বার যখন আসি, তখন ছিল শুধু সাদা আর সাদা। আর এখন শুধু সবুজ আর সবুজ। সাথে বৃষ্টি তো আছেই! কিছুক্ষণ পরেই নাস্তার জন্য ব্রেক দিল। জায়গাটার নাম মনে নেই, মান্ডির আশেপাশে। রেস্টুরেন্টের এক পাশ দিয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে যাচ্ছে শো শো করে। সেটা আসলে একটা নদী – নাম বিপাশা। অসাধারণ লাগল। সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে ফটোসেশনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। পরে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে সবাই বাসে উঠে পড়ল। পথে মান্ডি, কুল্লু আর থ্রি ইডিয়টস টানেল পেরিয়ে যাচ্ছি মানালির দিকে। সকাল ১১টায় আমরা মানালী স্ট্যান্ডে পৌছালাম।
আমাদের যে হোটেলে বুকিং ছিল গিয়ে দেখি সেই হোটেল রিনোভেশনের জন্য বন্ধ। পরে পাশের হোটেলে তাড়া ব্যবস্থা করে দিল। হোটেল থেকেই পাহাড়ি ঢল দেখা যাচ্ছে। খুবই সুন্দর ভিউ ছিল। ওহ হ্যাঁ, ননস্টপ বৃষ্টি চলছিল। ফ্রেশ হয়ে আমরা খেতে আর সাইট-সিয়িং এ বের হলাম। দুপুরে যেখানে খেলাম, এই ট্যুরের সেরা খাবার। হোটেলের নাম শান্তিনিকেতন। অসাধারণ রান্না। ভেজ নন-ভেজ সবই ছিল। সবচেয়ে ভাল লেগেছে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে পুইশাকের একটা আইটেম। সবাই ৩-৪ বার করে নিয়েছে, আহ কি স্বাদ, এখনো মুখে লেগে আছে। সবাই ঠিক করলাম যে রাতেও এখানেই খাব।
দুপুরের খাবার পড় বের হয়ে ঘুরে এলাম – হিড়িম্বা মন্দির, গরম পানির কুয়ো, ক্লাব হাউজ ইত্যাদি। গরম পানির কুয়ো থেকে সব সময় গরম পানি উঠতে থাকে। অনেককে সেখানে গোসলও করতেও দেখা যায়। এত ঘুরেও সবার মন খারাপ। কারণ ঐ যে, বৃষ্টি! কয়েকজনই বলল এরকম বৃষ্টি থাকলে রোটাং বন্ধ থাকবে। সবাই মিলে বের করলাম, এই বৃষ্টি থামানোর একটাই উপায়, সবাই পয়সা খরচ করে রেইন কোট কেনা। যেই ভাবা সেই কাজ। ১০জন রেইনকোট কিনে ফেললাম। বাকিজনের সাইজটা একটু বেসাইজ, তাই ও কিনল না
রেইনকোট কেনার কিছু সময় পরেই বৃষ্টি কমতে শুরু করল। আর আমরা চলে গেলাম ম্যাল রোডে। গোলাব জামুন খেলাম ইচ্ছেমত। সাথে সিঙ্গারা, আহহ! অনেকে কিছু কেনাকাটা সেরে নিল। আসার সময় খেতে গেলাম আমাদের প্রাণপ্রিয় রেস্তোরা শান্তিনিকেতনে। আর গিয়ে দ্বিতীয়বার ধোঁকা খেলাম
এবার একটা আইটেমে লবণই দেয়নি। একুটুও লবণ না দিয়ে কিভাবে একটা হোটেলে রান্না হয় আমার মাথায় কুলোয় না। আর বাকি আইটেম গুলো যাচ্ছেতাই ছিল। অবশ্য দুপুরে আমরা থালিতে যা খাইছি, এতে ওদের মনে হয় লসই হইছে, তাই রাতে এই ব্যবস্থা।
২৪শে সেপ্টেম্বরঃ সকালে উঠে সবারই মন খুব ভাল। আগেরদিন রেইনকোট কেনা কাজে আসছে। সকালে উঠেই আমরা রোদ পেলাম। যদিও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে এটা থেমে যাবে। যাত্রা শুরু হল রোটাং এর উপর থেকে জিসপা এর উদ্দেশ্যে, যেখানে আজ রাতে থাকব আমরা। প্রথমেই পেলাম রানিনালা ঝর্না। কলকল করে পাহাড় বেঁয়ে নেমে আসছে। আর সে কি গর্জন। সেখানে কিছু সময় পার করে নাস্তার জন্য থামলাম কোঠিতে। আমরা আস্তে আস্তে উপড়ের দিকে উঠছি আর আমাদের মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। নাস্তার অর্ডার দিয়েই চলছে ফটোসেশন। প্রতিটা মুহুর্ত ধরে রাখার প্রতিযোগিতা! কোঠিতে নাস্তা শেষ করার কিছু সময় পড় পৌঁছে গেলাম প্রথম পাস – রোটাং লা তে। লা কথার অর্থ হল পাস। পাস মানে হল একটা পাহাড়ের রাস্তার সর্বোচ্চ অংশ। পুরো র্যুটে এরকম কয়েকটা পাস পড়বে। রোটাং পাস হল ১৩০৬০ ফুট উচ্চতায়। দূরে পাহাড়ে বরফ দেখতে পেলাম। সামনে অনেকটাই ফ্লাট এক পাশে। ঠাণ্ডা বাতাস হু হু করে বয়ে যাচ্ছে। মিনিট খানেক দৌড়েই আমরা হাঁপিয়ে গেলাম! বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছিলাম শেখানে। যদিও ঠাণ্ডাটাও জেঁকে বসেছিল।
রোটাং পাসের আরেক নাম হল লাশের মিছিল। সব চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা নাকি এখানে হয়েছে। যদিও এখন রাস্তা অনেক ভালো, কিন্তু অনেক ড্রাইভারই সন্ধ্যার পর এখান দিয়ে যায় না। আর মানালী থেকে যাওয়াও যায় না, পারমিশন দেয়না যতদূর জানি।
আমরা আবার নিচে নেমে যেতে থাকলাম। দু পাশে পাহাড় দেখতে দেখতে আর আড্ডা মারতে মারতে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল। আমরা সবাই মোটামুটি খাউয়াল টাইপ ছিলাম, চান্স পেলেই খেতে নামতাম আর ড্রাইভার তাড়া দিত যাতে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারি। নেক্সট খোকসারে পৌঁছে আমরা কিছু খেয়ে নিলাম, আর পাশাপাশি বাথরুম সেরে নিলাম। একটা হলে আর একটা তো লাগবেই, হেহে। খোকসার থেকে আমরা চলে গেলাম কিলং। আমরা যেহেতু মাঝে এক জায়গায় নাইট স্টে করব, তাই সবাই আমাকে বলেছিল কিলং এ থাকতে। আমি চেয়েছিলাম প্রথম দিন যতটা পারি এগিয়ে থাকতে। তাই আমি চেয়েছিলাম জিসপা। কিলং গিয়ে দেখি, এটাও কাজে লেগে গেছে। কিলং এ কয়েকটা হোটেল আছে ঠিক, কিন্তু জায়গাটা অনেক ছোটো আর দেখার তেমন কিছু নেই। ওখানেই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। দুপুরের পর পৌঁছে গেলাম জিসপাতে। অসাধারণ একটা জায়গা। আমাদের হোটেলটাও ছিল খুবই সুন্দর একটা প্লেসে। হোটেলের রুম থেকে সামনে খুবই সুন্দর ৩টা পাহাড়, তার আগে একটা নদী। পাহাড়ি নদী আসলে পাহাড়ের ঢল। তার পাড়ে আবার হাজার হাজার পাথর। বিকেলেই ঠিক করলাম যে রাতে বার-বি-কিউ করব। আর ঠাণ্ডা থেকে মুক্তির জন্য ৩ জন চলে গেল গরম পানীয় আনতে।
রাতটা বেশ মজা করেই কাটালাম আমরা। পোর্টেবল স্পীকারে গান, বার-বি-কিউ আর পানীয়, আহা। জিসপাতে কোন খাবার হোটেল নেই। আর থাকার হোটেলে খাবার খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। তাই আমাদের গাড়ি করে আমরা একটু সামনে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আসলাম। পরদিন আবার ভোরে উঠতে হবে, অনেক লম্বা জার্নি।
২৫শে সেপ্টেম্বরঃ ভোর ৫টায় আমরা জার্নি শুরু করলাম। অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে আজ। মাঝে দারচা নেমে আমরা নাস্তা সেরে নিলাম। কিছুক্ষণ পড় পৌঁছে গেলাম আর একটি বড় পাস – বড়লাচা লা তে। এটা ১৬৫০০ ফুট উঁচুতে। অনেক উপর থেকে দেখতে যে কি ভালো লাগে, সেটা এখান থেকে প্রথম বুঝলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রইলাম দূরে, অনেক দূরে। আগের রাতে স্নোফল হয়েছিল। খুব কাছে না হলেও ভালই কাছ থেকে বরফ দেখতে পেলাম। আধা ঘণ্টার মত সময় কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম সারচু। মাঝের রাস্তায় এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আপনি নামতে চাইবেন না। রং বেরঙয়ের বিভিন্ন পাহাড়। কিছু আছে শুধু পাথরের পাহাড়। সেই পাহাড়ে আবার বিভিন্ন আকৃতির কারুকাজ করা। আবার কখনো মনে হবে বিভিন্ন পশু পাখি বা মানুষের আকৃতি।
দেখতে দেখতে চলে এলাম সারচুতে। এখানে আমরা খুব বেশি সময় কাটাইনি। এর কিছু পরে পেলাম বিখ্যাত গাটা লুপ। একটা পাহাড়ে একই জায়গায় ২১টা লুপের মত রাস্তা দিয়ে নিচ থেকে উপড়ে উঠে। এখানে একটা ছোটো সমাধি আছে। কথিত আছে, অনেক অনেক দিন আগে খুবই দুর্গম আবহাওয়াতে এক ড্রাইভার এক অসুস্থ লোক নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এখানে এসে গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। পরে ড্রাইভার সাহায্যের জন্য পাশের গ্রামে গিয়ে অনেক ঠাণ্ডা আর স্নোফলে আটকা পড়ে। ৩ দিন পড় এসে দেখে যে অসুস্থ লোকটা মারা গিয়েছে। আর পাশে লেখা ছিল পানি। এরপরেই নাকি ওখানে একটা সমাধি করে। আর অনেকেই যাবার সময়, সমাধিতে কিছু পানি দিয়ে যায়। গাটা লুপের একটু পরেই পরপর ২টা ছোটো ছোটো পাস – নাকী লা আর লাচুং লা।
প্যাং গিয়ে লাঞ্চ করার প্লান আমাদের। ক্ষুধাও লেগেছে সবার। তাই বেশি দেরি না করে উঠে গেলাম গাড়িতে। ২ ঘণ্টা পড় পৌঁছে গেলাম প্যাং এ। এখানে একটা আর্মি ক্যাম্প আছে। কারও শরীর খারাপ থাকলে এখানে দেখানো যায়, কোন টাকা লাগে না। স্থানীয় একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এর খানিকটা পরেই পেলাম মুর প্লেন। একটানা অনেক অনেক খানি রাস্তা একদম প্লেন রোড। কোন আঁকাবাঁকা নেই, কোন উঁচুনিচু নেই। দুই পাশে মরুভূমি আর মাঝখানে রাস্তা!
এর কিছুক্ষণ পড় পৌঁছে গেলাম আর একটা পাস এ – টাংলাং লা তে। এটা ১৭৪৮০ ফুট উঁচুতে। এই ট্যুরে প্রথম বার বরফের স্বাদ পেলাম – একদম কাছ থেকে। সবাই শুরু করল বরফের মধ্যে লাফালাফি, দাপাদাপি। খুবই ঠাণ্ডা একটা বাতাস – কিন্তু সেদিকে কার খেয়াল। সবাই বাচ্চাদের মতই দাপাদাপি করতে লাগল, সাথে হল বরফ ছোড়াছুড়ি। বরফ না, আসলে বলা উচিত তুষার।
এখানে ভালই সময় পার করলাম আমরা। তারপর চললাম উপশির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যায় আমরা ওখানেই কিছু খেয়ে নিলাম। কারুর একটু কাছে আসার পরেই পেলাম ইন্দু নদী। বাকিটা সময় আমাদের পাশেই বয়ে চলল ইন্দু নদী। আমরা আর কারু তে না থেমে সরাসরি লেহ তে চলে গেলাম। রাত তখন প্রায় ৮টা।
এই হোটেল টা ছিল আমাদের ট্যুরের সেরা হোটেল। এর মালিক অসাধারণ একজন মানুষ। দেখতে অনেকটাই জ্যাকি চ্যাং এর মত। সবাই-ই তার সাথে সেলফি তুলে নেয়। তার স্ত্রী আর সহকর্মীরাও অনেক ভাল আর ফ্রেন্ডলি। রাতে সেখানেই ডিনার সারলাম। আর রাতেই পাসপোর্ট গুলো দিয়ে দিলাম হোটেল মালিকের কাছে যাতে উনি পারমিশন বের করতে পারে নুব্রা এবং প্যাংগং এর জন্য।
এই রাতেই খারাপ ঘটনাটা ঘটল। আমাদের একজন যাত্রার শুরু থেকেই একটু অসুস্থ বোধ করছিল। মাঝে কয়েক জায়গায় বমি হয়েছে তার। লেহ তে আসতে আসতে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে আমাদের সাথে একজন অ্যান্টি ছিল। বয়স ৫৫+। রাতে ওনার মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয় আর সাথে কোল্ড এটাক। থরথর করে কাঁপছিল। ৩/৪টা মোটা কম্বল দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। আমরা তাকে হস্পিটালাইজড করতে চেয়েছিলাম। পরে গরম পানির ব্যাগ কম্বলের মধ্যে দেবার পড়, উনি ঘুমিয়ে যায়।
২৬শে সেপ্টেম্বরঃ যদিও পরদিন সকাল থেকে সবাই সুস্থ। পরদিন এটাও জানতে পারলাম যে, ঐ অ্যান্টি অফিসিয়াল পাসপোর্ট ধারী এবং জিও নিয়ে গিয়েছে বিধায়, তিনি পারমিশন পাবেন না। পারমিশন পেতে হলে ভিসা থাকা আবশ্যক। আর যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সে এবং তার স্ত্রীও লেহ তে থেকে যাবার প্লান করল। তাদের আসলেই বিশ্রামের দরকার ছিল।
আমরা নাস্তা শেষে বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিয়িং এর জন্য। ঘুরে এলাম শান্তি স্তুপা, লেহ প্যালেস আর কয়েকটা মনেস্ট্রি। আমার কাছে ভাল লেগেছে শান্তি স্তুপা, উপর থেকে লেহ শহরটা অসাধারণ দেখতে! দুপুরে লাঞ্চ করেছিলাম লামায়ুরু রেস্তোরা তে। রাতেও সেখানে। খাবার বেশ ভাল লেগেছে। আমরা লেহ তে হোটেলের বাইরে যতবার খেয়েছি, ওখানেই খেয়েছি।
২৭শে সেপ্টেম্বরঃ ভোর থেকেই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যাত্রা শুরু করার। কিন্তু একটু ঝামেলার কারণে আমাদের দেরি হয়ে গেল। একসাথে অনেক লোক গেলে এরকম ২/১ বার হবেই – কিন্তু আমাদের একটু বেশিই লস হয়ে গেল, যেটা এই ট্যুরে আমাদের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হয়ে আছে। যাই হোক আমরা শুরু করলাম ১২টার একটু পরে, উদ্দেশ্য নুব্রা। আমাদের প্লান ছিল, প্রথমে নুব্রা মেইন পয়েন্ট, এর পরে ডিস্কিট, হুন্দার আর তুর্তুক। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে নুব্রা মেইন পয়েন্ট আর তুর্তুক বাদ দিতে হয়। আমরা পরে সরাসরি হুন্দার চলে যাই। সেখানে আছে অদ্ভুত দুই কুঁজওয়ালা ঊট। যেতে যেতেই সন্ধ্যা হবার কারণে আমরা সবাই আর উঠতে পারলাম না। আর অনেক সিরিয়াল ছিলাম। ওখানে একটা ঊট অসুস্থ্য ছিল। পরে অনেক রিকোয়েস্ট করে শুধু মহিলাদের একটু উঠানোর জন্য রাজি হল, কিন্তু কোন টাকা নিল না। সেখানে আরও ছিল কোল্ড ডিজার্ট। অত উঁচুতে ঠাণ্ডা বাতাস আর বালুর মরুভূমির মধ্যে হেতে বেড়ালাম। সন্ধ্যার পড় ফিরে এলাম ডিস্কিটে। সেখানেই রাতে থাকলাম।
২৮শে সেপ্টেম্বরঃ খুব ভোরে রওয়ানা হলাম আরেক স্বপ্নের উদ্দেশ্যে – প্যাংগং লেক! অনেকেই বলেছিল নুব্রা থেকে প্যাংগং এর রাস্তা বেশি ভাল না। কিন্তু রাস্তা আসলে খুবই ভাল। মাঝে শুধু ৫-৭ কিলোমিটার রাস্তা আসলে রাস্তা না – চারিদিকে শুধু পাথর পাথর – তার মধ্য দিয়ে। যেহেতু সেই রাস্তা পাহাড়ের উপড়ে বা পাশে না, বরং প্লেন জমিতে, তাই ভয়ের কিছুই নেই। প্যাংগং এর ঠিক একটু আগে সেনাবাহিনী এর একটু অনেক বড় ক্যাম্প আছে, তার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। নিজেকে ভিআইপি লাগে তখন।
ওখানে ছবি তোলা নিষেধ। এর কিছু পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম প্যাংগং লেক। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কতদিন অপেক্ষা করেছি, কত স্বপ্ন দেখছি এই লেকের পড়ে আসার জন্য, এই লেকের পানি একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য। প্রায় ১৫ হাজার ফুট উঁচুতে এত সুন্দর একটা সল্ট লেক। তবুও শীতকালে পুরোটা বরফ হয়ে যায়। এই লেকের পানির রং মুহুর্তে বদলায়। আবার এক সাথেই ৩-৪ রকম নীল রঙয়ের শেড দেখা যায়। রাতে এখানেই আমাদের তাবুতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু যে ঠাণ্ডা বাতাস, আর সাহস করিনি। লেহ এর হোটেলে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসার আগে ওখানেই লাঞ্চ করে নিলাম। প্রায় দু ঘণ্টার মত ছিলাম ওখানে। ফিরে আসার সময় মনটাই অনেক খারাপ হয়ে গেল সবার। কেমন যেন একটা টান!
ফিরে আসার পথে আমরা পেলাম দাবীকৃত সর্বোচ্চ মটরেবল পাস – খারদুং লা। যদিও এটা আর সর্বোচ্চ নেই এখন। খারদুং লা তে অনেকের একটু শ্বাসকষ্ট হয়। অনেক উঁচুতে তো, তাই। কখনো কখনো দিয়াশলাই জ্বালানো যায় না। কিন্তু যে অনুভূতি আপনি পাবেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আপনার মনে হবে আপনি আসলেই স্বর্গের দরজায়। একবার মনে হবে সব কিছু কত ক্ষুদ্র আপনার তুলনায়। আবার মনে হবে আপনি কত ক্ষুদ্র সব কিছুর তুলনায়! সেখানে ২০ মিনিটের মত ছিলাম। সন্ধ্যার একটু পরে নেমে আসলাম লেহ তে।
২৯শে সেপ্টেম্বরঃ এদিন আমরা পুরোটাই লেহ ঘুরে কাটালাম। ২-১টা মনেস্ট্রি ঘুরে গেলাম থ্রি ইডিয়টস স্কুলে, যেটাকে বলে রাঞ্চোস স্কুল। এটার আসল নাম হল দ্রুক হোয়াইট লোটাস স্কুল। স্কুলতঁই খুবই সুন্দর আর পরিষ্কার। ওদের নিজস্ব কয়েকটা সায়েন্স প্রজেক্ট আছে। ঐ প্রজেক্টে আবার স্কুলের ছেলেমেয়েরাই কাজ করে। অনেক বড়ও কয়েকটা সোলার প্যানেল আছে স্কুলের জন্য। আর যত ঠাণ্ডাই পড়ুক, রুম হিটার লাগে না স্টুডেন্ট হলে। গ্লাসগুলো এমন যে, দিনের বেলা তাপ ধরে রাখে আর রাতের বেলা ভিতরটা গরম রাখে! খুবই ভাল লাগল স্কুলটা ঘুরে। সন্ধ্যার পরে চলে আসলাম লেহ তে। সেদিন আবার ছিল আশুরার আগের রাত। লেহ তে ৫০% হল শিয়া মুসলিম। তারা মার্কেটের মধ্যে আশুরার মার্কেটে কিছুটা ঘুরাঘুরি, কেনাকাটা আর স্ট্রীট ফুড খেয়ে রাতে ঘুমাতে চলে গেলাম। পরদিন আবার যেতে হবে কারগীল।
৩০শে সেপ্টেম্বরঃ সকালে নাস্তা সেরে আমরা কার্গিলের জন্য যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে আমরা পেলাম সঙ্গম পয়েন্ট যেখানে ইন্দুস নদী আর জান্সকার নদী এসে মিলিত হয়েছে। দুইটা নদীর পানির রং ভিন্ন। উপর থেকে এক রকম ভাল লাগে। আবার একদম নিচেও যাওয়া যায়, সেখান থেকে অন্য রকম ভাল লাগবে। সেখানে থেকে বেরিয়ে পরে যেখানে নামলাম সেটা হল ম্যাগনেটিক হিল। এটা আরেকটা অদ্ভুত জায়গা। কোন একটা কারণে এখানে মাধ্যাকর্ষন শোকটি উল্টো কাজ করে। গাড়ি নিউট্রালে রেখে দিলে, গাড়ি আস্তে আস্তে উপড়ের দিকে উঠে, নিচের দিকে নামে না। পৃথিবীতে আরও কয়েকটা এরকম জায়গা আছে। এর পরে নামলাম আমরা লামায়ুরু মনেস্ট্রিতে। সব চেয়ে সুন্দর লেগেছে আমরা এটা। অনেক বড় আর রহস্যময় লেগেছে। আর হাতের কি কাজ, উফফ! আর এখান থেকে নিচের সর্পিল পেঁচানো রাস্তাটা অসাধারণ লাগে দেখতে। ওখানেই আমরা লাঞ্চ করে নিলাম। এর পড় সরাসরি কার্গিল। মাঝে অবশ্য আরও কয়েকটা জায়গায় আমরা নেমেছি, কিন্তু নাম মনেই নেই সব জায়গার। ঐ যে বললাম, আপনার সব জায়গায়ই নামতে ইচ্ছে করবে! সন্ধ্যার দিকে পৌঁছে গেলাম কার্গিলে। উপর থেকে কার্গিল শহরটা দেখতে গল্পের মত লাগে, মনে হয় আর্ট করা। কার্গিলে গিয়ে দেখি আশুরা এর কারণে সব বন্ধ। কালও নাকি বন্ধ থাকবে। আমরা রাতের খাবার হোটেল খুঁজলাম অনেকক্ষণ ধরে। অনেকদিন ধরে ভাল মত চিকেন খায়না বিধায় অনেকেই নন-ভেজ হোটেল খুঁজতে লাগল। সব বন্ধ ছিল বিধায়, রাস্তায় হাঁটতে খুবই ভাল লেগেছে। ঢাকার মত করে চিৎকার চেঁচামেচি করে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি, গান গেয়েছি। ২/১ জন স্থানীয় লোক অবাক চোখে আমাদের দেখেছে। রাতে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হল। কাল খুব ভোরে রওয়ানা দিতে হবে। কেননা আশুরা এর মিছিলের কারণে ৮টা থেকে রাস্তা বন্ধ হবে দ্রাসে।
১লা অক্টোবরঃ ভোর ৫টায় রওয়ানা দিলাম। ৭টার দিকে পৌঁছে দ্রাস। পৃথিবীতে ২য় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এখানে হয়। আমরা গাড়ি থেকে নেমে ১০ মিনিট ছিলাম, কিন্তু ঠাণ্ডায় এখানেই কাবু হলাম সব চেয়ে বেশি। ১০টা মিনিটে মনে হল জীবনের সব ঠাণ্ডা এক পারে পাইয়ে দিল। নেমে আমরা চা খেলাম। এই চা এখানে ১৫ সেকেন্ডে ঠাণ্ডা হয়ে যায়! ১০টার দিকে পেলাম এই র্যুটের সবচেয়ে ভয়ংকর পাস – জোজি লা। প্রায় ২৫ কিমি রাস্তা একদম যাতা। অনেক জায়গায়ই ২টা গাড়ি পাশাপাশি যাবে না। বর্ষাকালে এই পাসে পার হওয়া অনেক টাফ আর সময় সাপেক্ষ। এর একটু পরে পেলাম সোনমার্গ। সেখানে নেমে আমরা কিছুটা সময় কাটালাম আর নাস্তা করলাম। এর কিছুক্ষণ পরে চলে গেলাম শ্রীনগর। এবং গিয়ে দেখলাম, যে সব বন্ধ। এমনকি গাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। মার্কেট বন্ধ। যাদের অনেক অনেক কেনাকাটার প্লান ছিল, মাঠে মারা গেল। আমাদের গুলমার্গ যাবার প্লান বাদ দিতে হল। বিকেলে শিকারা ভাড়া করে ডাল লেকে ঘুরলাম অনেকক্ষণ। সন্ধ্যের আগে ডাল লেকের মার্কেটে গেলাম কেনাকাটার জন্য। অনেক ধরনের দোকান। এক চাঁচার দোকানে দেখলাম হাতে বানানো হাজারো কাঠের আইটেম। এখানে দাম অনেকটাই কম। পশমিনা চাদর ৭০০ থেকে শুরু। সেমি পশমিনা কিনতে গেলে ১৫০ টাকাতেই পাবেন। পরে কিছু ড্রাই ফুড কিনে রাতে হাউজ বোটে চলে এলাম। আহা, হাউজ বোট। দারুণ এক অনুভূতি। লেকের উপর বোটের মধ্যেই রুম। সারা রাত হালকা করে দুলে। কেউ একটু হাঁটলে তো দুলেই। বেশ ভাল লাগে। রাতের দিকে বোটের মালিকের সাথে বসে বোটের সামনে বসে আড্ডা দিলাম। ওনার বয়স ৮০+। কাশ্মীরের ইতিহাস শুনলাম। ওনার ব্যাবসার ইতিহাস শুনলাম। রাতে স্থানীয় একটা হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেলাম। রাতের ঘুমটা খুবই ভাল হয়েছিল।
২লা অক্টোবরঃ সকালে শুরু করলাম পেহেলগামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিন্তু তার আগে ঘুরে নিলাম শালিমার গার্ডেন, মুঘল গার্ডেন, তারাশংকর মন্দির। আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ লেগেছে শ্রীনগরের মানুষ। টাউট বাটপারে ভর্তি। আবার হতে পারে, ছুটি ছিল বিধায় সব ভাল লোকেরা বাইরে ব্যাড় হয়নি। এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে কম। ট্যাক্সি ড্রাইভার হোটেল মালিককে বিশ্বাস করে না, অথচ সবাই একসাথে বিজনেস করে। যাই হোক, কিছুদূর গিয়ে অনেক বড় একটা ড্রাই ফুডের দোকানে থামলাম। সবাই ইচ্ছেমত কিনে নিলাম। এরপর অনেকগুলো ক্রিকেট ব্যাটের ফ্যাক্টরি। উইলো কাঠ দিয়ে ব্যাট বানায় এখানে। আমরা একটাতে নেমে ঘুরে দেখলাম কিভাবে বানায়। মাঝে এক জায়গায় লাঞ্চের জন্য থামলাম। তখন শুনলাম শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নাকি সন্ত্রাসী এটাক হয়েছে। ৩ জন মারা গেছে। পরিস্থিতি থমথমে। অবস্থা খারাপ হলে নাকি কারফিউ জারি হতে পারে। আমরা তখনই পেহেলগাম থেকে অন্য কোথাও যাবার প্লান বাতিল করলাম, আর পরদিন যত তাড়াতাড়ি পারি জম্মুর উদ্দেশ্যে বের হতে চাইলাম।
যাই হোক, বিকেলে নাগাদ আমরা পেহেলগাম ঢুকলাম। ঢুকতেই মনটা ভাল হয়ে গেল আবার। ঢুকতে না ঢুকতেই আবার সেই ঢল, এবার একদম রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেল। আমরা নেমে কিছু ছবি তুলে, সন্ধ্যার পর হোটেলে পৌঁছলাম। এখানেও সেই একই অবস্থা, আশুরার জন্য অনেক দোকানই বন্ধ। সন্ধ্যায় লাড্ডু-সিংগারা খেলাম। রাতে আর একটা জঘন্য খাবার খেলাম – লবণ ছাড়া নুডলস রান্না! রাতে এসে সবাই দ্রুত শুয়ে পড়লাম।
৩য় অক্টোবরঃ খুবই ভোরে যাত্রা শুরু করলাম জম্মুর উদ্দেশ্যে। এই রোডে জার্নিটা খুবই খারাপ লেগেছে। একটু পরপর চেকপোস্ট, সাথে ড্রাইভারের কাছ থেকে ঘুষ খাওয়া। আর রাস্তা খুবই ভাঙ্গা। সাথে প্রচুর ধুলা। সময় লেগেছে প্রায় ৮ ঘণ্টা, কিন্তু খুবই বাজে জার্নি ছিল। সরাসরি জম্মু স্টেশনে নামি আমরা, কারণ বিকেলে রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেন দিল্লীর জন্য। সময়মতো ট্রেন ছাড়ল। আবারো সেই খাওয়া দাওয়া। রাতের ঘুম শেষ হতে না হতেই দিল্লী এসে পড়লাম।
৪র্থ অক্টোবরঃ কোলকাতার যে এজেন্টের মাধ্যমে টিকিট কাটলাম, সেই শালায় এখানে এসে বেইমানী টা করল। সে আমাদের দিল্লী থেকে কোলকাতার টিকিট দিতে পারেনি, কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। পরে আমি তাকে ক্যান্সেল করতে বলে নিজেরা চেষ্টা করি। ফরেইন কোটায় গিয়ে দেখি কন টিকিট নেই। শেষে একজন এজেন্ট ধরে র্যাক এ টিকিট পাই। দাম পড়ে প্রায় ডবল। র্যাক মানে একটা স্লিপারে ২জন যাবে। কিন্তু আমাদের আরও উপায় নেই। আমাদের কারও ঢাকা ফেরার টিকিট ৫ তারিখেই। ৫ জন যদিও দিল্লী থেকে আলাদা হয়ে যায়, এবং বাকি ৬ জন র্যাকে টু-এসি টিকিট কেটে ফেলি। একটা টেনশন ছিল যে এজেন্টের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাবো কিনা, কারণ ও যে ধান্দাবাজ তা আমরা আগেই টের পেয়েছিলাম। যদিও পরে ওর গলায় পাড়া দিয়ে আমরা টিকিটের টাকা উঠিয়ে নিয়ে আসি পরদিন, সে আরেক কাহিনী।
৫ই অক্টোবর সকালে কোলকাতা নেমে যথারীতি আমি ঐ দিদির বাসায় চলে গেলাম। ৬ তারিখ কোলকাতা ঘুরে, ৭তারিখ মৈত্রী তে করে আবার ঢাকা।
আমাদের পার পারসন খরচ পরেছিল ৪০-৫০ হাজারের এর মত, এক এক জনের এক এক রকম। তবে নেট ৪০ লেগেছিল।
ঐ জোচ্চোর দালাল এর প্রোফাইল লিঙ্কঃ www.facebook.com/subho.das.775 (এর থেকে দূরে থাকুন)